বৃষ্টি কিভাবে হয় সে বিষয়টি দীর্ঘ সময়
পর্যন্ত একটি রহস্যময় ব্যাপার ছিল। আবহাওয়া নির্ণয়ের জন্য মাত্র কিছুদিন
আগে যখন রাডার আবিষ্কৃত হলো, তার পর পরই জানা গেল বৃষ্টি উৎপন্ন হওয়ার
পর্যায়গুলো। সে অনুসারে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় তিনটি পর্যায়ে। এমনকি ষোড়শ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে বিজ্ঞানী ফ্লেজ মিলিটেস Hydrological science সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে তত্ত্বটি উপস্থাপন
করেছিলেন তা ছিল অসম্পূর্ন। বেশ কয়েকটি ধাপের বর্ননা তার তত্ত্বে অনুপস্থিত
ছিল যার মধ্যে মেঘে ঠাণ্ডা বায়ুর উপস্থিতি ও বাষ্পের স্তরীভূত হওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখ
ছিল না, যা কুরআন সাড়ে ১৪০০ বছর পূর্বে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
বাষ্পীভূত পানি রৌদ্র বা বায়ুপ্রবাহের
মাধ্যমে উপরে বাতাসে উঠে আসে, এরপর মেঘমালা উৎপন্ন হয় আর অবশেষে বৃষ্টিকণা
দেখা দেয়।
কুরআনে প্রদত্ত বৃষ্টি উৎপাদনের বর্ণনাটি
ঠিক এ পদ্ধতিরই উল্লেখ করেছে।
اللَّهُ
الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَيَبْسُطُهُ فِي السَّمَاءِ
كَيْفَ يَشَاءُ وَيَجْعَلُهُ كِسَفًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ ۖ
فَإِذَا أَصَابَ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
তিনি আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর তিনি মেঘমালাকে আকাশে সঞ্চারিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে
স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে
পাও তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টিধারা। তিনি তাঁর বান্দাদের
মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা তা পৌছেঁ দেন। তখন তারা আনন্দিত হয়। (আর রুম ৪৮)
আয়াতটিকে বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায়-
প্রথম পর্যায়-তিনি আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন।
সমুদ্রের ফেনায় উৎপন্ন বায়ুর অসংখ্য বুদবুদ
বিরামহীনভাবে ফেটে গিয়ে পানির কণাসমূহকে আকাশের দিকে বিক্ষিপ্ত করে। এরপর লবণে পরিপূর্ণ এই কণাগুলো বাস্পীভূত হয়ে উপরে অর্থাৎ বায়ুমন্ডলে উঠে যায়। এই কণাগুলো (এরোসল নামে) পানির ফাঁদ হিসেবে কাজ করে আর নিজেদের চারদিকে পানি
বাষ্প জড়ো করে উৎপন্ন করে মেঘকণা। তৈরী মেঘে পানি
কণাগুলো বাতাসে ঝুলে থাকে আর পরে সেগুলো ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়
পর্যায়-অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে সঞ্চারিত করেন।
বাতাসে ভাসমান লবণ স্ফটিক কিংবা ধূলিকণার
চারদিকের পানি কণিকা ঘনীভূত হয়ে উৎপন্ন হয় মেঘমালা। কেননা মেঘমালায়
বিদ্যমান পানি কণাগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র (০.০১-০.০২ মিলি মিটার ব্যাস) হওয়ায় মেঘসমূহ
বাতাসে ঝুলে থাকে আর আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই মেঘে পরিপূর্ণ হয়ে ঢেকে যায় আকাশ।
তৃতীয় পর্যায়-তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে নির্গত হয়ে
আসে বৃষ্টিধারা।
লবণ স্ফটিক কিংবা ধূলিকণার চারিদিকে ঘিরে
বিদ্যমান পানিকণাগুলো ঘন ও ভারী হয়ে তৈরি করে বৃষ্টির কণা। এরপর বাতাসের চেয়ে
ভারী বৃষ্টিকণাগুলো মেঘ থেকে সরে আসে এবং বৃষ্টিধারা হিসেবে মাটিতে নেমে আসতে শুরু
করে।
মহান আল্লাহ তা’আলা এভাবে মানুষ বৃষ্টির পর্যায়গুলো উদঘাটন করার চৌদ্দশত
বছর পূর্বেই কুরআনের মধ্যে এই রহস্যের সমাধান দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, সূরা
নূরের ৪৩ নং আয়াতটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
أَلَمْ تَرَ
أَنَّ اللَّهَ يُزْجِي سَحَابًا ثُمَّ يُؤَلِّفُ بَيْنَهُ ثُمَّ يَجْعَلُهُ
رُكَامًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاءِ
مِنْ جِبَالٍ فِيهَا مِنْ بَرَدٍ فَيُصِيبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَصْرِفُهُ عَنْ
مَنْ يَشَاءُ ۖ يَكَادُ سَنَا بَرْقِهِ يَذْهَبُ
بِالْأَبْصَارِ
তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন। তারপর মেঘগুলোকে একত্র করেন এবং পরে তা পুঞ্জীভূত করেন স্তরে
স্তরে, অতঃপর তুমি দেখতে পাও, সে মেঘের মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টি। আর তিনি আকাশস্থিত পাহাড়সদৃশ মেঘমালা থেকে বর্ষণ করেন শিলা। সে মেঘের বিদ্যুতের চমক এমন, যেন মনে হয় দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়।
বিজ্ঞানীগণ মেঘমালার প্রকার পর্যবেক্ষণ
করতে গিয়ে ‘বৃষ্টির মেঘ’ উৎপত্তির এক বিস্ময়কর তথ্য জানতে পারেন। সুনির্দিষ্ট সিস্টেম ও পর্যায় সমূহের মধ্য দিয়ে তৈরী হয় এবং আকার ধারণ করে বৃষ্টির
মেঘমালা। এ মেঘমালা বিন্যস্ত রয়েছে স্তরে স্তরে অনেকগুলো পর্যায়ে-
১নং পর্যায়-মেঘমালাসমূহ সঞ্চালিত হয়ে থাকে বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে।
২নং পর্যায়-সংযোগীকরণ, পুঞ্জীভূতকরণ, এর
পর বায়ুবাহিত ক্ষদ্র ক্ষুদ্র মেঘমালা একত্রিত হয়ে তৈরি করে বৃহত্তর মেঘ।
৩নং পর্যায়-বাস্পীকৃত হওয়া।
ছোট ছোট মেঘমালা একত্রে সংযুক্ত হলে বিশাল
মেঘমালার মাঝে আপড্রাফট (Updraft)
বেড়ে যায়। এই আপড্রাফট মেঘমালার প্রান্তভাগের
চেয়ে অভ্যন্তরভাগে বেশী জোরালো। এ প্রক্রিয়াতে মেঘগুলো খাড়াখাড়িভাবে বা
লম্বালম্বিভাবে জমা হয়ে বাড়তে থাকে। এভাবেই মেঘমালাসমূহ স্তরে স্তরে সজ্জিত
হয়। মেঘের এই খাড়া বৃদ্ধি মেঘকে বায়ুমন্ডলের শীতলতর স্থানের দিকে
টেনে নিয়ে যায়, সেখানেই উৎপন্ন হয় পানিবিন্দু আর শিলা। এগুলোই বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত
হয় আকাশে। যখন এই শিলা ও পানি বিন্দুগুলি বেশী ভারী হয়, যখন মেঘের এই ওজন আর বহন করতে পারে না তখন মেঘ থেকে এরা মাটিতে
পতিত হতে থাকে বৃষ্টি, শিলা ইত্যাদিরূপে।
মেঘের আপড্রাফটের ফলে স্তরে স্তরে মেঘমালা
লম্বালম্বিভাবে বৃদ্ধি পায়। লম্বালম্বিভাবে বৃদ্ধির ফলে মেঘদেহটিকে
বায়ুমণ্ডলের অধিকতর ঠাণ্ডা অঞ্চলে টেনে নিয়ে যায় যেখানে বৃষ্টির পানি ও শিলা তৈরি হতে থাকে এবং বৃদ্ধি পেতে থাকে। যখন এই শিলা
এবং বৃষ্টিকণা অতিরিক্ত ভারী হয়ে যায় তখন মেঘের আপড্রাফট আর মেঘমালাসমূহকে ধারণ করতে না পারায় মেঘগুলো হতে বৃষ্টি
বা শিলাবৃষ্টি রূপে নীচে পতিত হতে থাকে। সাড়ে ১৪০০ বছর পূর্বে
মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ কুরআনের বহু আয়াতে এই জটিল বিষয় সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত
প্রদান করেছিলেন।
ফাইয়াজ আল-মুহাইমিন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন