শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

রহস্যেঘেরা সমুদ্রতল



গভীর সমুদ্রের নীচে নিকষ অন্ধকারপূর্বে মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ ২০-৩০ মিটার পর্যন্ত যাওয়া যেতোমানুষ, বিশেষত: যারা সমুদ্রে মুক্তা সংগ্রহ করে, সাধারণত সমুদ্রের ২০ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত গভীরে ডুব দেয়, যেখানে তারা সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পায়কেউ যদি ২০০ মিটারের (৬৬০ ফুট) বেশি নীচে যায় পানির প্রচণ্ড চাপে সে মারা যাবেআলো যখন সাতটি রং (বেগুনী, নীল, সবুজ, কমলা, লাল, আসমানী, হলুদ) নিয়ে পানিতে প্রবেশ করে তখন প্রতি ১৫-২০ মিটার পরপর এক একটি অদৃশ্য হতে শেষ পর্যন্ত বেগুনি রংটি পানির ২০০ মিটার পর হারিয়ে যায়গভীর সমুদ্র ও মহাসমুদ্রসমূহের গভীরে ২০০ মিটার ও তারও নীচে এক আঁধার পরিবেশ বিরাজ করেএ পরিমাণ গভীরতায় প্রায় কোন আলো নেইআর প্রায় ১০০০  মিটার (৩২৮০ ফুট) গভীরতায় একদমই কোন আলো থাকে না
প্রফেসর দূর্গারাও একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিখ্যাত সমুদ্র ভূ-তত্ত্ববিদতিনি বলেন, বিজ্ঞানীরা আজ সাবমেরিনের মাধ্যমে সমুদ্রের অন্ধকারাচ্ছন্নতার কথা জানতে পেরেছেঅথচ আল-কুরআন বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছে অনেক আগেইতিনি গবেষণা করে বলেন, আল্লাহ সাগর বক্ষের যে অন্ধকারের কথা বলেছেন, তা যে কোন সাগরের জন্য নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যধারী সাগরের জন্যই আল্লাহর এ বর্ণনাপরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে এ জাতীয় অন্ধকার স্তরের দুটি কারণ-(১) রং এবং (২) আলো
সমুদ্রের পানিতে আলো প্রবেশ করার পর তা তার অঙ্গীভূত সাত বর্ণে বিভক্ত হয়সমুদ্র বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একথা প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, সমুদ্রের গভীর অংশ একটি সুনির্দিষ্ট বর্ণ বা নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো শুষে নেয়তারা সম্প্রতি দেখিয়েছেন, লাল বর্ণই সর্বপ্রথম ৩০ মিটার গভীর পর্যন্ত শোষিত হয়অন্য কথায়, যদি কোনো ডুবুরী আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং এই গভীরতার মধ্যে তার শরীর থেকে রক্ত বের হয় সে তা দেখতে পায় নাদ্বিতীয় যে রং শোষিত হয় তা হল কমলাপরে হলুদ বর্ণ, যা শোষিত হয় ৫০ মিটার পর্যন্তএরপরে সবুজ ও বেগুনী বর্ণ ১০০ মিটার গভীর পর্যন্ত শোষিত হয় এবং সর্বশেষ যে বর্ণ শোষিত হয় তা হল নীল, যা ২০০ মিটার পর্যন্ত প্রবেশ করেএভাবেই সাগরের তলদেশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যায় এবং এই অন্ধকারাচ্ছন্নতা বিরাজ করে বিশেষ স্তরসমূহে, একটির পর অন্যটিএটা শুরু হয় ৩০ মিটার গভীরতা থেকে এবং পর্যায় ক্রমে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বর্ণ স্তরে ২০০ মিটার গভীর পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, এরপরে বিরাজ করে পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্নতা (এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা)
আমরা জানি যে, মেঘ হলো ঘনীভূত জলীয়বাষ্পের সমষ্টিএর মধ্যে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি-কণা এবং তুষার-কণা! এই কণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়বৃষ্টি-ভরা মেঘকে বলা হয় জমাট মেঘ, যার আকার বিশাল মেঘের পর্বতের মতএর খাড়া উচ্চতা বেশ দীর্ঘ এবং অন্ধকারাচ্ছন্নএর গভীরতার ব্যাপ্তি ২৫,০০০ থেকে ৩৫,০০০ হাজার ফুটের মধ্যেউপর থেকে সূর্যের আলো যখন একে ভেদ করে তখন আলো প্রতিফলিত হয়ফলে সূর্য-কিরণের বড় অংশটা মেঘ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঢেউ এর উপর পড়ে কদাচিৎ পানির গভীরতা অতিক্রম করতে পারেএর ফলে সাগরের তলদেশে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বিরাজ করেএ ধরনের অন্ধকারে কেউ তার নিজের হাত পর্যন্ত দেখতে পায় নাএমনকি হাত চোখের সামনে তুলে ধরলেওতাহলে বোঝা যাচ্ছে, অন্ধকারের গভীরতা কতটা বিশাল!
আমরা জানি আলোক রশ্মি সৃষ্টি হয় সূর্য থেকেআর মেঘমালা সূর্যের নীচে অবস্থান করে একটি প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেএটাই অন্ধকারের প্রথম স্তরঅতঃপর সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপরে আলোক রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে নিম্নদেশে আরেকটি অন্ধকার সৃষ্টি করে এটা হল দ্বিতীয় স্তরআর যে সমুদ্রের ঢেউ নেই তথায় আলোক রশ্মি প্রতিফলিত হয় নাআর অপ্রতিফলিত আলোক রশ্মি সমুদ্র বক্ষের অনেক গভীর পৌঁছতে সক্ষমএ ভাবেই মহাসাগরকে দুটি স্তরে বিন্যস্ত করা যায়একটি হল উপরিভাগ আরেকটি হল নিম্নভাগসাধারণত উপরিভাগ বিশেষভাবে আলো ও উষ্ণতাপূর্ণঅপর দিকে গভীরাংশ অন্ধকার ও শীতলতায় পূর্ণআবার উপরিভাগ ঢেউ দ্বারা চিহ্নিত আর নীচের অংশ শান্ত বলেই পরিগণিততবে কোন কোন সময় নীচের অংশেও প্রচন্ড ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়যা মেরিন বিজ্ঞানীরা ১৯০০ সনে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেসমুদ্রের গহীন অন্ধকারে এবং অতল গভীরে মাছেরাও দেখতে পায় নাঅন্য কোন প্রাণীর দেখার বিষয়টি তো প্রশ্নই আসে নাবিজ্ঞান এসব তথ্য আবিষ্কার করেছে অতি সম্প্রতি অথচ কুরআন এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে ১৪০০ বৎসর পূর্বেইতরঙ্গের ওপর তরঙ্গ, ঢেউয়ের ওপর ঢেউ, বিষয়টি উপলব্ধির জন্য আমরা নিম্নোক্ত বর্ণনাটির প্রতি লক্ষ্য করতে পারি এমন এক যুগে এ আয়াত নাজিল হয়েছিল সে যুগে ছিল না কোন ডুবুরিনা ছিল কোন জাহাজ, না ছিল কোন আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সেই যুগের মানুষের জানা ছিল না যে সাগরের অভ্যন্তরীণ তরঙ্গ রয়েছেসাগরের গভীর তলদেশে রয়েছে অন্ধকার একথাও ছিল তাদের অজানা, আসলে এ ধরনের জ্ঞান সেই যুগে কোন মানুষেরই থাকা সম্ভব ছিল না

এখন দেখা যাক, কুরআন কতটা স্পষ্টভাবে এ বিষয়গুলো র্ব্ণনা করেছিল ১৪০০ বছর পূর্বে।

أَوْ كَظُلُمَاتٍ فِي بَحْرٍ لُجِّيٍّ يَغْشَاهُ مَوْجٌ مِنْ فَوْقِهِ مَوْجٌ مِنْ فَوْقِهِ سَحَابٌ ۚ ظُلُمَاتٌ بَعْضُهَا فَوْقَ بَعْضٍ إِذَا أَخْرَجَ يَدَهُ لَمْ يَكَدْ يَرَاهَا ۗ وَمَنْ لَمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَا لَهُ مِنْ نُورٍ
অথবা (তাদের কর্ম) প্রমত্ত সমুদ্রের বুকে গভীর অন্ধকারের ন্যায়, যাকে উদ্বেলিত করে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, যার উপরে ঘন কালো মেঘ আছেএকের উপর এক অন্ধকারযখন সে তার হাত বের করে, তখন তাকে একেবারেই দেখতে পায় নাআল্লাহ যাকে জ্যোতি দেন না, তার কোন জ্যোতিই নেই (আন নূর ৪০)

কোন ধরনের বিশেষ যন্ত্রাদির সাহায্য ছাড়া মানুষ সাগরের ৪০ মিটার গভীরে যেতে পারে না২০০মিটার গভীরে সমুদ্রের গভীর অন্ধকার অংশে কোন প্রকার সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না মানুষএ সমস্ত কারণেই বিজ্ঞানীগণ অতি সম্প্রতি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সমুদ্র সম্পর্কে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম তথ্যাদি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন যা একশত বছর পূ্র্বেও মানুষের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো।

অধুনা সমুদ্রের সাধারণ গঠনপ্রণালী, এর মাঝে বিদ্যমান জীবসমূহের বৈশিষ্ট্যাবলী, এর ঘনত্ব, এর ধারণকৃত পানির পরিমাণ, এর পৃষ্ঠতল আর গভীরতা সম্পর্কে আমরা জানতে পারিঅথচ ১৪০০ বছর আগেই সূরা নূরে সমুদ্রের আঁধারশব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিলএটা অবশ্যই কুরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণের পক্ষে একটি যুক্তি, কেননা এ তথ্যটি কুরআনে এমন সময় প্রদান করা হয়েছে, যখন মহাসমুদ্রের গভীরে গিয়ে তথ্যাদি খুজেঁ আনার মত কোন যন্ত্রাদির অস্তিত্বই ছিল না

অধিকন্তু, তরঙ্গের পর তরঙ্গ, যার উপরে রয়েছে কালোমেঘ, অন্ধকারের উপর অন্ধকার-এ আয়াতটিও কুরআনে বর্ণিত আরেকটি অলৌকিক বিষয় হিসেবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করেছেন যে, সমুদ্রে রয়েছে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা যারা পানির ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বের স্তরের মাঝে সৃষ্টি হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে অবস্থান করেআভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা বা ঢেউসমূহ সাগর ও মহাসাগর সমূহের গভীর পানির স্তরগুলো ঢেকে থাকে, কেননা উপরকার পানির চেয়ে ভেতরের পানির রয়েছে বেশী মাত্রার ঘনত্ব

আজকের যুগের সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রকাশিত যে, গভীর সাগরের তলদেশ অত্যধিক অন্ধকারচ্ছন্ন এবং সেখানে রয়েছে তরঙ্গ বা ঢেউ যেমন ঢেউ রয়েছে পানির উপরিভাগেউপগ্রহের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক ছবি সংগ্রহ করে বিজ্ঞানীরা এসব তথ্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেনঅথচ আজ থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে পবিত্র কুরআন আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলোর কথা নিখুঁত সত্যতার সাথে  বলে দিয়েছেএটি কুরআন মাজিদের একটি মুজিজা, তা কেবল সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার সম্পর্কেই বর্ণনা দেয় নি; বরং তার অন্ধকারের অবস্থা সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেবলেছে, ‘অন্ধকারএক স্তরের ওপর আরেক স্তরঅন্ধকারের এই অবস্থা সম্পর্কে বর্তমানে সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছেঅথচ বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য এ নিদর্শনখানা পবিত্র কুরআনে সূরা নূরে ১৪০০ বছর আগেই ঘোষিত হয়েছিল যা মাত্র কিছুদিন পূর্বে Oceanologist-গণ উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন


Faiyaz Al Muhaimin

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন